Header Ads

Header ADS

মোখলেস মুকুল ও তার বাঙ্গালিয়ানা


ভাষাকে যদি বলি একটি বৃক্ষ, প্রশ্ন আসে তার শেঁকড়ের। তার কাণ্ডের। শাখা-প্রশাখা-পাতা-ফুল-ফলের। তার লতা, ডগা, বাকলের। শেঁকড় ছাড়া বৃক্ষ বাঁচে না। যে বৃক্ষের শেঁকড় যতো গভীরে প্রোথিত, মাটির উপরে তার দাপট ততো বেশি। কোনো বৃক্ষ লতার মতো। জড়িয়ে থাকে প্রকৃতিকে। কোনোটি এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে আকাশচুম্বী। কোনো বৃক্ষের ফুল মিষ্টি, কোনোটার ফল। কোনোটার ডাল-বাকল-পাতা-ফুল-ফল সবই মিষ্টি। কোনো বৃক্ষের ফল তেতো, কোনোটা ঝাল। আবার কোনোটি সুগন্ধী। কোনো গাছ কেবল মাটির রস আর সূর্যরশ্মি থেকেই নিজের আহার গ্রহণ করে। কোনোটি আবার পোকা-মাকড় খায়। সম্প্রতি জানা গেলো মানবখেকো বৃক্ষও আছে এই পৃথিবীতে।

বৃক্ষের ডালে বসে পাখি গান করে, বাসা বেঁধে বাস করে নির্বিঘ্নে। ভাষাও বৃক্ষের অনুরূপ। মানুষের কণ্ঠ হলো তার ভূমি। একটি জাতির অতীত, তার শিষ্ঠাচার, জাতীয় গৌরব নির্ভর করে- তার মুখের ভাষার উপর অনেকখানি। বাংলা ভাষার জন্য সাধেই কি আর রক্ত দিতে পেরেছিলো এই ভাষার জন্য! সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর দাবীতে খেয়েছিলো তারা বন্দুকের গুলি। বক্শীবাজারের শহীদ মিনার কালের স্বাক্ষী, জাতির গৌরবের প্রতীক। 

ভাষার ব্যবহার এক রকম নয়। বলা, লেখা কাজ-কর্মে ভাষা নানারূপে ব্যবহৃত হয়। বলতে গিয়ে আমরা যেভাবে বলি, লিখতে গেলে লিখি অন্যভাবে। আবার কবিতা, গল্প এসব লিখতে গেলো এসে যায় ভাষার আরেক চেহারা। ভাষা মানুষের সাথে মানুষকে, সমাজের সাথে সমাজের, রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের মেলবন্ধন তৈরী করে। এক এক মুখের উচ্চারণ এক এক রকম। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। আমরা বাংলায় কথা বলি, লিখি, গান করি, করি ভাবের আদান-প্রদান।

আমাদের এই বাংলা ভাষা কিন্তু একদিনে বর্তমান অবস্থায় আসে নি। কালের বিবর্তনে সমাজ উন্নয়ন, ধর্ম, সংস্কৃতি নানাবিধ কারণে পরিবর্তন হতে হতে বর্তমান অবস্থায় এসে পেঁছেছে- আজকের বাংলা ভাষা। আমরা ভাষা নিয়ে গর্ব করি। ভাষার জন্য জীবন দিতেও কুণ্ঠা করি না। মায়ের মুখের ভাষা প্রাণের চেয়েও দামী। বর্তমানে বাংলা ভাষায় গুগল সার্চ, মোবাইল এ্যাপ বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিকীকরণ করেছে। পৃথিবীর বহু দেশেই এখন বাংলা ভাষা-ভাষীরা বাস করে। বাংলাদেশের শহীদ দিবস একুশে ফেব্রুয়ারি হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এটা আমাদের কম পাওয়া নয়। বাংলা ভাষা যতোদূর, বাংলাদেশ ততোদূর।

পটভূমিঃ

মোখলেস মুকুল এমনই একজন লেখক, যিনি বাংলার হারানো গৌরব-ঐতিহ্যকে জাতির সামনে তুলে ধরার প্রচেষ্টায় সর্বদা নিয়োজিত। গত বারের প্রকাশিত উপন্যাসমৃন্ময় বৃক্ষতার জলন্ত প্রমাণ। এবার তিনি খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছেন বাংলা ভাষার আদি রূপ, বাঙ্গালী ভাষা জাতির উত্থানের সময়। জন্য তিনি চর্যাপদ পর্যালোচনা এবং প্রাচীন ইতিহাস হাতড়িয়ে তথ্য সংগ্রহ করে- সেই সময়ের জীবন ধারাকে তুলে ধরার লক্ষে রচনা করেছেন এবারের উপন্যাসবঙ্গালী ভইলী

প্রকাশনার তথ্যঃ

উপন্যাসের নামঃ        বঙ্গালী ভইলী

ঔপন্যাসিক            মোখলেস মুকুল

প্রকাশনা                 বটেশ্বর বর্ণন

প্রথম প্রকাশ          ফেব্রুয়ারি, ২০২১

প্রচ্ছদ                      . কে. এম খালেকুজ্জামান

মূল্য                        ৭০০.০০ টাকা

 

বঙ্গালী ভইলীএকটি ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস। বাংলা ভাষার আদি কবিদের নাম, তাদের জীবনাচরণ, সংঘর্ষ-সংকল্প, সফলতা-ব্যর্থতা ইত্যাদি এই উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়।

“বাজণাব পাড়ী পঁউআ খালেঁ বাহিউ

অদব অবাঙ্গালে দেশ লুড়িউ

আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী

ণিঅ ঘরিণী চণ্ডালে লেলী

 

বর্তমান বাংলাদেশের চর্যা কবি ভুসুকুপা-এর এই দোহা বা শ্লোক মোখলেস মুকুলকে তার উপন্যাসের নামবঙ্গালী ভইলীনামকরণে উদ্বুদ্ধ করেছে, একথা তিনি নিজেই তাঁর গ্রন্থের শেষ প্রচ্ছদে বর্ণনা করেছেন।


উপন্যাসের কাহিনী

উপন্যাস পাঠে দেখা যায়, হালিক জালিক দুই বন্ধু। প্রথম জন সাহসী। দ্বিতীয় ভীতু কিন্তু জ্ঞান পিপাসু। জ্ঞান পিপসুরা কি ভীতু হয়? নিজের দিকে তাকাই। আমি কি ভীতু? মানবতাবোধে ছাড় দিয়ে চলাটাকে ভয় বলে কি গণ্য করা যায়? যা বলছিলাম, হালিকের সাথে জালিকের বন্ধুত্ব দৃষ্টান্ত দেয়ার মতো। হালিক জালিককে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলেও জালিক যখন তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, তখন সে জালিকের কোনো কথার বিপরীতে যেতে পারে না। জালিকের অনুরোধেই হালিক সাড়া দেয়- জালিকের জ্ঞান তৃষ্ণা নিবারণে। দুজনে লুকিয়ে মন্দীরের পেছনে গিয়ে বেদবাক্য শোনে এবং তা অধ্যয়ন চর্চা করে। সে কাল কেনো আজকের দিনেও সাধারণ বৈদিক ধর্মাবলম্বীদের বেদ স্পর্শ করা নিষেধ। গৌতমবুদ্ধ ব্রাহ্মণ শব্দটির নতুন তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দেয়। সাধারণ মানুষ কর্তৃক তা সমাদৃত হয়। ব্রাহ্মণ যেহেতু সম্মানীয়, আর তাই- একদিকে জ্ঞান পিপাসা অন্যদিকে সম্মানিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় অনেকেই বেদ শ্রাস্ত্রের জ্ঞান লাভের জন্য অনুপ্রাণিত হয়। হালিক জালিক তাদের মতোই দুইজন। তারা দরিদ্র। নিচু বংশের। কিন্তু বেদ শাস্ত্রের প্রতি তাদের আকাঙ্ক্ষা- যেনো ব্রাহ্মণকেও হার মানায়। উপন্যাসের আরম্ভ এখানেই।

ব্রাহ্মণ পণ্ডিত চলেন গ্রামের ক্ষমতাধর জমিদারের বগলে বগলে। কোনো অন্যায়কে ন্যায় বলে চালানোর জন্য শাস্ত্রমতে পণ্ডিতের পরামর্শ লাগে। পণ্ডিত কোনো কথা বললে- তা কার্যকর করা আর বেদ শাস্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যেনো একই কথা। ব্রাহ্মণেরা যুগে যুগে ক্ষমতার কাছাকাছি থেকেছে। আজও তারাই শীর্ষে। হাতিয়ার হিসেবে আছে শাস্ত্র। এই হাতিয়ার যেনো নষ্ট না হয়, তা যেনো সাধারণ মানুষ ব্যবহার করার সুযোগ না পায়- সে জন্যেই হয়তো বেদ শাস্ত্রকে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার এই প্রাণান্ত চেষ্টা। হালিক জালিকের বেলাতেও তা- ঘটেছে। গ্রাম্য জমিদার হালিকের উপর চরম জুলুম অত্যাচার করে। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে হালিক মারা যায়। জালিক নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে তার বাবাও খুন হয়। স্বামী শোকে জালিকের মা- মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার প্রতি বুকের মধ্যে জমানো প্রচণ্ড ক্ষোভ আর ঘৃণা নিয়ে জালিক দেশান্তরী হয়। দৈবক্রমে সিংহলের রাজপ্রাসাদে বড়ো হয়ে অবশেষে নানা বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে উঠতি যৌবনে তার কাঙ্ক্ষিত উরুবেলা জ্ঞানপীঠে হাজির হয়। যাবৎ কালে তার চলার সঙ্গী হিসেবে ছিলো শৈশবের গঙ্গাধরের কিছু বাণী পরবর্তীতে রক্তচক্ষুঅলা একটি পাখি। প্রথম দিন সে যখন পাখিটিকে দেখেছিলো, সে ভয়ই পেয়েছিলো। এখন আর তার ভয় করে না। বরং পাখিটাকে দেখে তার মনে হয়, সে সঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছে। আর অচেনা জায়গাগুলিতে এলেই গ্রামের সবজান্তা তাম্বুলরাঙা ওষ্ঠের পক্ককেশী গঙ্গাধরের বাণী- তাকে জায়গাটিকে চিনিয়ে দেয়। অপরিচিত জায়গাটি আর তার অচেনা থাকে না।

এখানে কথা না বললেই নয় যে, বঙ্গালী ভইলীতে উরুবেলা নামক স্থানের তৎকালীন যেই বিবরণ এখানে পাওয়া যায়, তা যেনো আজও বিদ্যমান প্রায় সকল ধর্মপীঠে। কালী ভক্ত সাধুরা আজও অর্ধনগ্ন অবস্থায় জীবন-যাপন গাঁজা সেবন করে থাকে। হাতে ত্রিশূল, মুখে ছাই মাখিয়ে নিজেকে বিভৎস এক রূপে উপস্থাপন করতেই যেনো তারা বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করে। মন্দীরে গান-বাজনার আড়ালে এক ধরণের প্রেম-বিরহ আজও বিদ্যমান রয়েছে। মুসলিমদের মধ্যে মাজারে ভক্তিমূলক গান আর জিকিরের তালে নৃত্য তেমনই একটা বিষয় বলে মনে করার যথেষ্ঠ কারণ রয়েছে। মন্দীরের বিদ্যার্থীদের মধ্যে সরল রসবোধ, আদাচূর্ণের সাথে নেশা জাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে তা সেবন করার যেই বিবরণ এই উপন্যাসে পাওয়া যায়, তা অবাস্তব মনে হয় না আজকের দিনেও। ধর্মের নামে মাজারে মন্দীরে এর সবই হয়ে থাকে। ধর্ম জ্ঞানে জ্ঞানী সাধু-বিজ্ঞজনের উপস্থিতি আজকের দিনেও বিরল। সাধারণ মানুষের উপর নিপীড়ন সেই পুরাতন নিয়মেই চলে আসছে। জ্ঞানসূলভ কোন কথা কর্তৃত্ববাদীদের স্বার্থহানী ঘটাতে পারে, এমন সন্দেহে তার উপর নেমে আসে ফতোয়া, বেদের বিধান আর সংগে সামাজিক নিপীড়ন। সব কালে, সব যুগে সাধারণ মানুষ কেবল ধর্মের সেবা করে গেছে আর ধর্মের সেবা নিয়েছে ধর্মের শীর্ষস্থানীয় ব্যাক্তি, ব্যাক্তিবর্গ। মানুষকে শাসন, শোষন করার জন্যই যেনো ধর্মের উপস্থাপনা। যেই মানুষের জন্য ধর্মের সৃজন, সেই মানুষ রয়ে গেছে ধর্মীয় সুবিচারের বাইরে। এখানে সময় যেন স্থির, অবিচল।

যাহোক, জালিক সিংহলে ইন্দ্রানীকে এড়িয়ে চললেও ভেতরে ভেতরে তার প্রেমে পড়েছে বুঝা যায়। কিন্তু পরবর্তীতে বারবার নারীর প্রতি তার আকর্ষণ লক্ষ্যণীয়। গানের বালিকার জন্য তার মন ব্যাকুল হতে দেখা যায়। তার শিক্ষাসঙ্গী ধেনু বেশ রসিক বুঝা গেলো। জালিক যার পরিবর্তিত নাম শুভ সামন্ত তথা শুভ তার চলাচল এখন বুদ্ধ মতের লোকেদের ভীঁড়ে।

উপন্যাসটিতে বুদ্ধমতের বিরুদ্ধে বৈদিক মতের যেই দ্বন্দ্ব- তা বেশ পরিস্কারভাবেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। জালিক যেহেতু অচ্ছুৎ নিচু জাতের মানুষ, ব্রাহ্মণরা তাকে পছন্দ করে না। জন্য বুদ্ধমতের প্রতি তার অনুরক্ত থাকার বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু জালিকের দীক্ষা লাভের পূর্বেইহে ভগবান বুদ্ধ, রক্ষা করোএহেন বাক্য উচ্চারণ উপন্যাস পাঠে ধাক্কা লেগেছে।

“বুদ্ধং শরনং গোচ্ছামি, ধর্মং শরনং গোচ্ছামি, সঙ্ঘং শরনং গোচ্ছামি। জয়তু মনুষ্য। জয়তু বুদ্ধতন্ত্র। জয়তু বুদ্ধ।

কথার সারমর্ম জালিক বুঝতে সক্ষম হয়। কারণ, সে সংস্কৃত বুঝে। সঙ্গত কারণেই ব্রাহ্মণগণও বুঝতে পারে। বৈদিক ধর্মের বিরুদ্ধে কেউ- বিশেষ করে ন্যাড়া মাথার লোকেদের উপর তারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে। কেউ কিছু বলতে গেলেই ভাষার কারণে তারা তা বুঝে যায় এবং যারা বলে তাদের উপর নেমে আসে অত্যাচারের খড়্গ। এমতাবস্থায় বুদ্ধমতের লোকেরা নিজেদের বক্তব্য গোপন রাখার স্বার্থে পালি ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং এই ভাষার মাধ্যমে ব্রাহ্মণদেরকে উপযুক্ত জবাব প্রদান করতে উঠে পড়ে লাগে মর্মে উপন্যাসটিতে উল্লেখ রয়েছে।

কাহিনী আরও অগ্রসর হলে দেখা যায়, শুভ সামন্ত শেষমেষ গঙ্গাধরকে অগ্রজ গুরু হিসেবে মেনে নেয়। তারপর শবরপা এর নিকট গিয়ে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। এইখানে এসে তার ভালো লাগে। শবরপাকে সে আযদেব বা আর্যদেব নামে সম্বোধন করে। উল্লেখ্য, এখানে শবরপাকে আর্যদেব কেনো বলা হলো, সে বিষয়ে কিছু লেখা হয় নি। শবরপা এর রচিত গীত তার খুব ভালো লাগে। গুরুদেবের নিকট জানতে চায় সে- ভাষার নাম কী। গুরু এটাকে প্রাকৃত ভাষার পরিবর্তিত রূপ উল্লেখ করে। শুভ ভাষাটির নাম বঙ্গভাষ রাখার প্রস্তাব রাখে। এই সময়টাতেই নাটকীয় এক ঘটনা ঘটে। একদিন মন ভালো না থাকায় শুভ সামন্ত ভ্রামরী মন্দীরে গিয়ে বীনা বাজাতে বাজাতে মগ্ন হয়ে যায়। সময় কিভাবে গড়িয়েছে সে বুঝতে পারে না। ফেরার পথে এক ডাকিনী তার পিছু নেয়। ডাকিনী নয়, জ্যান্ত ডোমনী। শুভকে প্রেম নিবেদন করে। সে তা প্রত্যাখ্যান করায় তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। আত্মরক্ষার জন্য শুভ তীর ছুঁড়ে ডোমনীকে রক্তাক্ত করে। ফলশ্রুতিতে ডোম সম্প্রদায়ের লোকেরা শবরপার চর্যাগৃহ জ্বালিয়ে দেয়। গুরু শবরপা বঙ্গে ফিরে যান। শুভ কয়েক দিন পালিয়ে সবকিছুই দেখতে পায়। অবশেষে সে- চর্যাগৃহের নামফলক চুম্বন করে সে স্থান ত্যাগ করে। পরবর্তীতে জানা যায় নাম ফলকটি সে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলো।

এক পর্যায়ে সে চক্রবর্তী রাজ্যের সুদূর উদীচী প্রতীচীর গান্ধার রাজ্যের নিকটবর্তী উদ্যানের রাজা পূর্ণেন্দু নন্দীর রাজ সভায় স্থান পায়। রাজা ক্ষত্রীয়। তবে জাত-পাতে বিশ্বাস করেন না। শুভ নিজের দেশ বলতে বঙ্গদেশ উল্লেখ করে। পথে যৌবনে সুখ বিক্রী হয় এমন স্থান হয়ে কপর্দকশুন্য শুভ সামন্ত রাজদূতের সাথে বর্ষাকালের শুরুতে রাজার গৃহে প্রবেশ করে।

এই দূরদেশে সে একা। রক্তচক্ষু অচিন পাখিটিকে সে অনেক খুঁজেছে। পায় নি। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে পেয়ে যায় তাম্বুলরাঙা ওষ্ঠের পক্ককেশী বাক্যবাগীশ বৃদ্ধ গঙ্গাধরকে। হঠাৎ ধেনুর উপস্থিতি পাওয়া গেলো। গান গাওয়া। শুভ বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। রাজসভা কবির কন্যার সাথে সামান্যক্ষণের প্রণয়, পক্ষিটির ফিরে আসা। গুরু শবরপার স্মৃতি রোমন্থন। তিনি বলেছিলেন- যেখাইনেই যাও বারো বছর বা তার অধিক সময় নির্জনে তন্ত্রসাধনা করবে, তবেই সিদ্ধি লাভ করতে পারবে। সামন্তশুভ কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়- এমন কোথাও যাবে যেখানে নদী থাকবে, প্রকৃতি থাকবে, পক্ষি থাকবে, জানোয়ার থাকবে। কিন্তু মানুষ থাকবে না, মিত্র থাকবে না, প্রেমিকা থাকবে না, আত্মীয় থাকবে না। পরদিন খুব ভোরে সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে শুভ সামন্ত রাজা পূর্ণেন্দু নন্দীর রাজ্য উদ্যান থেকে প্রস্থান করে।

পরের ছত্রিশ বছর কেটে যায় তার তপস্যা, জ্ঞান চর্চা সিদ্ধি লাভের সংগ্রামে। এই সময়টা তার ভালোই কাটে। সঙ্গী-সাথীদের সাথে প্রতিযোগিতামূলক জ্ঞান চর্চা করে সিদ্ধি লাভ করে। ভিক্ষা বৃত্তির মাধ্যমে জীবন যাপন করে বলে- সাধারণ লোক তাকে ভিক্ষুক বা লুই নামে ডাকে, যা সে পরবর্তীতে বুঝতে পারে। এরপর থেকে জালিক তথা শুভসামন্ত লুই নামেই গল্পের শেষ পর্যন্ত বিচরণ করে। সেকালে সিদ্ধি লাভকারী শ্লোক রচনাকারীদের নামের সাথে পা যুক্ত করা হতো। সুতরাং তার নামের সাথেও পা যুক্ত হয়ে তার নামও লুইপা হয়ে যায়। লুইপার জীবদ্দশায় আবারও চর্যাগৃহ আক্রান্ত হয়। এখানে অবশ্য আক্রমণের ভার মন্ত্রীদের উপর চাপিয়ে দিয়ে রাজা মহাশয়কে রক্ষা করা হয়েছে। রাজা মহাশয় নিঃসন্দেহে ব্রাহ্মণ ছিলেন। কর্তৃত্ববাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেলে কর্তৃত্বদানকারীদের সহায়তা করার প্রয়োজন আছে বৈ কি!

লুইপা এখন আর জালিক নয়। সে গান করে। গীত রচনা করে। বীণা বাজায়। একজন পরিপূর্ণ সিদ্ধাচার্য। সবাই তাকে সমীহ করে। তার প্রভাব সকলের উপর। এহেন অবস্থায়, চর্যাগৃহ পুনঃআক্রান্তের কারণে লুই মনে খুব কষ্ট পায়। মহারাজ ধর্মপালের কাছে নালিশ করবেন কি না চিন্তা করে এবং ভুলে যায়। নানা কিছু চিন্তা করে অবশেষে রামাবতী ত্যাগ করে লুইপা কামরূপের উদ্দেশে যাত্রা করে। এখানকার ভাষা তার চেনা-চেনা লাগে। এক পর্যায়ে সে শবরপার খোঁজ পায়। তিনি তখনো জীবিত ছিলেন সস্ত্রীক। সেখানে নতুন চর্যাগৃহ স্থাপন করে সেই পুরনো চর্যাগৃহ শীলা প্রতিস্থাপন করা হয়। সেখানে এক পর্যায়ে তার পুরনো সঙ্গী-সাথীর আগমন ঘটে। ভাষাপিতাদের নামের সাথে তার, তার সাথীদের নামও স্থান করে নেয়। এখানেই উপন্যাসের সমাপ্তি।


আলোচনাঃ

চর্যাগীতি রচনায় সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী হলেন ভুসুকুপা। তাঁর রচিত (আট)টি পদ চর্যাপদ গ্রন্থে সংযোজন করা হয়েছে। ভুসুকুপার প্রকৃত নাম শান্তিদেব। তিনি সৌরাষ্টের রাজপুত্র। শেষ জীবনে তিনি নালন্দায় বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেন। ভুসুকুপা চুপচাপ, একাকী এবং নিভৃতে থাকতে পছন্দ করতেন। সেজন্য ভুক্তির-ভু, সুপ্তির-সু এবং কুটিরের-কু এই তিন আদ্যাক্ষর যোগে তাঁকে ভুসুকু বলে পরিহাস করা হতো। . মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্র মতে ভুসুকু সাত শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বর্তমান ছিলেন। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে ভুসুকুর জীবনকালের শেষ সীমা ৮০০ খৃস্টাব্দ। ধর্মপালের রাজত্বকালে (৭৭০-৮০৬ খৃস্টাব্দ) ভুসুকুপা জীবিত ছিলেন। তিনি রাউত বা অশ্বারোহী সৈনিক ছিলেন। পরে ভিক্ষু সিদ্ধ হন।আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলি/ণিঅ ঘরিণী চণ্ডালে লেলীএই বাক্যে বুঝা যায় ৭৭০-৮০৬ খৃস্টাব্দ সময়ে বাঙ্গালী ভাষা গোত্র বা ভাষা জাতি অত্র অঞ্চলে বিদ্যমান ছিলো। সেহেতু অবঙ্গালের দেশ লুণ্ঠনের ঘটনা তার দেখা, সেটা আমরা ধরে নিতে পারি। আর পাল রাজবংশের রাজত্বকাল যদি সঠিক থাকে, তাহলে ভুসুকুর চর্যাপদবাণী রচনার কালও সঠিক আছে কথা বলা যায়।

পাল বংশের রাজত্বকাল দেখতে গিয়ে দেখা যায়- পাল রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গোপাল পাল। তিনি ৭৫০ থেকে ৭৭০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। গোপাল বাংলার শতবর্ষব্যাপী চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করে শাসনভার গ্রহণের জন্য সুপরিচিত। তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত "পাল" তাঁর কোনো জাতিগত পরিচয়কে নির্দেশ করে না। এখানেপালঅর্থ রক্ষাকর্তা বা রক্ষক। এখন যেমন রয়েছে রাজ্যপাল। গোপাল পালের মৃত্যুর পর তার পুত্র ধর্মপাল রাজ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর শাসনকাল ছিলো ৭৭০ থেকে ৮১০ খৃস্টাব্দ। ধর্মপাল ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলা অঞ্চলের পাল সাম্র্রাজ্যের দ্বিতীয় শাসক। তারপর দেবপাল ৮১০ থেকে ৮৫০ খৃস্টাব্দ। এরপর প্রথম মহীপাল অতঃপর ২য় মহীপাল এবং সর্বশেষ রামপাল ১০৭৭ থেকে ১১৩০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত রাজ্য শাসন করেন। অর্থাৎ ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজী বাংলা আক্রমণের বহুপূর্বেই পাল বংশের রাজত্বকাল শেষ হয়ে যায়।

চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে ভাষাবিদদের মধ্যে মতবিরোধ দেখানো হয়েছে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ মনে করেন- ৬৫০ খৃস্টাব্দ বাংলা সাহিত্যের আরম্ভকাল। ফরাসী পণ্ডিত সিলভ্যাঁ লেভি  তাঁর গ্রন্থে বলেছেন- “মৎসেন্দ্রনাথ (নাথপন্থার আদি গুরু) ৬৫৭ খৃষ্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গমন করেন ফলে এটা ধারণা করা অস্বাভাবিক নয় যে, ৬৫০ খৃস্টাব্দ এর দিকেই বাংলা সাহিত্যের লেখ্যরূপ লাভ করে, যদি চর্যাপদকে সাহিত্যের মর্যাদা দেয়া হয়। কিন্তু আরেকজন প্রখ্যাত ভাষাবিদ ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টপাধ্যায় উল্লেখ করেন, “মীননাথের শিষ্য গোরাক্ষনাথের সময় খৃস্টাব্দ ১২শ শতকের শেষে।তিনি বলেন মীননাথ দ্বাদশ শতকের লোক। এজন্য তিনি প্রাচীনতম বাংলা রচনার কাল ৯৫০ খৃস্টাব্দ বলে নির্দেশ করেন এবং সুকুমার সেনসহ বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব পণ্ডিতই সুনীতিকুমারকে সমর্থন করেন।প্রায় সব পণ্ডিতের সমর্থনবাক্যটি গোঁজামেলে। এই সব পণ্ডিত কারা ? চর্যাপদ সম্পর্কে তাঁদের কাজের বিবরণ কি? ৬৫০ খৃস্টাব্দ থেকে ৯৫০ খৃস্টাব্দ সময়কাল হচ্ছে ৩০০ বৎসর। এতো হের-ফের কি করে হয় ? ছাড়া ঘটনা প্রবাহকে ১২০০ সালের দিকে নিয়ে আসার কী কারণ থাকতে পারে? তা গবেষণার দাবী রাখে। উপরন্তু, ভুসুকুপা যদি ধর্মপালের রাজত্বকালে চর্যাপদ লিখে থাকেন তাহলে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম গ্রন্থের রচনাকাল কি করে ৯৫০ খৃস্টাব্দ হতে পারে ? তাহলে কি তিনি প্রাচীন চর্যাপদকে সাহিত্যের মর্যাদা দিতে চান নি ? একটি প্রশ্ন কিন্তু এখানেও থেকে যায়।

বর্ণিত বিষয়ে জানা যায়, শতাব্দীর পর শতাব্দী রাজা পরিবর্তন হয়েছে, রাজ্যের সীমানা রাজ্যের নাম পরিবর্তন করা হলেও একটি বিষয় কমন ছিলো- আর তা হলো লুণ্ঠণ। সব কালেই বঙ্গদেশ, গৌড়, সমতট, মগধ- অথবা মহাস্থান গড়, বরেন্দ্র ভূমি লুণ্ঠনের হাত থেকে কোনো অঞ্চল বাদ যায় নি। পাল বংশের রাজ্য এলাকা বর্তমান বাংলাদেশের নিলফামারী, সৈয়দপুর লুণ্ঠনের ঘটনা আমাদের সামনে দিবালোকের মতো স্বচ্ছ। বাংলাদেশের মানুষকে অবাঙালি বলার এটাও একটি কারণ যে, লুণ্ঠনের বৈধতার ব্যাখ্যা দেয়া যায়। ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়কে এতো বেশি আলোচনা করা হয়েছে যে, তথাকথিত বাঙ্গালী দাবীদারদের লুটতরাজ চাপা পড়ে যায়। বিষয়টি কতোটা আফসোসের যে, বাংলাদেশের কবি ভুসুকুপা বাংলা ভাষায় চর্যাপদ রচনা করলেও বাংলাদেশকে অবাঙালির দেশ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই তথাকথিত বাঙ্গালী কারা ? আমরা ইতোপূর্বে জেনেছি দুর্গা পূঁজাকে বাঙ্গালী সংস্কৃতির অংশ বলে প্রকাশ করা হয়েছে। হিন্দু জাতি স্বত্তার নাম যেমন সনাতন ধর্মের সাথে গুলানো হয়েছে যা দক্ষিণ ভারতে এক ধরণের দেব-দেবীর পূঁজা অর্চনা করা হয় ঠিক তেমনই উত্তর ভারতে বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বার সাথে সনাতন ধর্মের অপরাপর অন্য দেব-দেবীর পূঁজা অর্চনার প্রচলন করে ধর্মীয় আগ্রাসন চালানো হয়। যা এখনো চলছে। আপনারা বর্তমান ভারতেও দেখতে পাবেন, একই সনাতন ধর্মের অনুসারী হলেও- পূঁজা অর্চনায় দেব-দেবীতে পার্থক্য রয়েছে।

মোখলেস মুকুল ওনার উপন্যাসের প্রেক্ষাপট হিসেবে ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজির লক্ষণ সেনের আমলের বাংলা বিজয়কে নির্বাচন করেছেন। তার উপন্যাসের বিবরণ থেকে জানা যায় এলাকা থেকে বহু মানুষ পাক-ভারত উপমাহাদেশের বিভিন্ন এলাকায় হিজরত করে চলে যায়। তাদের কী পরিণতি হয়েছিলো বা তারা বর্তমানে কী অবস্থায় আছে সেটা কেউ কোনোদিন খতিয়ে দেখেন নি। সে সব তথ্য জানতে-বুঝতে গেলে একটা বিষয়ের দিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দৃষ্টি চলে যায়। বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশে যারা এসেছিলো তারা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলো। তাহলে, আর যারা অঞ্চলে আসে নি, তাদের ভাগ্যে কি হয়েছিলো। আজ তারা কেমন অবস্থায় পৌঁছেছে। এখানে প্রশ্ন আসে, তারা ভারত নেপালের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা দলিত নয়তো ?

 

দলিত। যার অর্থ ছিন্ন-ভিন্ন। দলিতরা বর্তমানের ভারত, নেপালে বসবাস করে। আসলে এরা কারা? তাদের মূল বাসস্থান কোথায়? তাদের এখনকার জীবনাচরণ দেখে কি মনে হয়? তাদের ধর্মীয় আচার আচরণ বুদ্ধ মতের মানুষের মতো নয়তো? বুদ্ধের কোনো শিক্ষা কি তাদের মধ্যে আছে? তারা কি জানে, তাদের পূর্ব-পুরুষের কেউ কেউ বৌদ্ধ ছিলো কি না? এদের জীবনাচরণ দেখলে কী একবারও মনে হয় না যে, এরাই বঙ্গদেশ থেকে পালিয়েছিলো এবং এরা তাদেরই বংশধর?

মহান ভারতে বর্ণবাদ সেই শুরু থেকেই। দেবতাদের মধ্যেও রয়েছে বৈষম্য। পূঁজা না দেওয়ায় দেবতা কর্তৃক শাস্তি প্রদানের রেওয়াজ বিদ্যমান। ব্রাহ্মণ (কর্তা), ক্ষত্রিয়, বৈশ্য শূদ্র জাতির বাইরেও অনেক মানুষ এই জনপদে বাস করতো। মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান তারাও ছিলো। যেহেতু হিন্দু ধর্মে (সনাতন ধর্মে) স্পৃশ্যতা বিদ্যমান, সেহেতু বৌদ্ধ, খৃস্টান, মুসলিমকে হিন্দু না বানিয়ে আলাদা  কোনো জাতি গোষ্ঠী বানানো যায় কি না, বা তাদেরকে নিয়ে কী করা যেতে পারে এটাই ছিলো কর্তৃত্ববাদীদের চিন্তা।

কর্তৃত্ব এমন একটি প্রক্রিয়া সেখানে আপন পর বলে কিছু থাকে না। ক্ষমতার বলয় থেকে ছিটকে পরা তথাকথিত এক শ্রেণির ব্রাহ্মণও সে সময় নিপীড়নের শিকার ছিলো। তারা চাষবাস করতো। ব্রাহ্মণদের মধ্যে দ্বন্দ ছিলো মূলতঃ মন্দীরের পূজারী হওয়াকে কেন্দ্র করে। একবার মন্দীরে বসতে পারলেই ক্ষমতা হাতের মুঠোয়। তাদের স্বার্থেই তারা মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলতো আর রাজা-জমিদারদের নিকট থেকে দক্ষিণা নিয়ে সেই ক্ষ্যাপা জনতার বিরুদ্ধে শাস্ত্রমতে ফরমান জারী করতো। জন্য জমিদার হোক, আর রাজাই হোক ক্ষমতাকে শক্তিশালী রাখতে তারা পণ্ডিতদেরকে সব সময় সন্তুষ্ট রাখতো। এই সন্তুষ্ট রাখার জন্য যা যা করা তারা তাই তাই করতো।

দক্ষিণে কালীর অনুসারী বেশি। উইকিপিডিয়া ঘেটে জানা যায়, চামুণ্ডাচর্চিকা কালীর পুঁজা বাংলা বহির্বঙ্গের একটি প্রাচীন উৎসব। বাংলায় কালীপূঁজা এসেছে অনেক পরে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে, আগ্রাসনের ভূমিকায়। মা কালীর ব্যবচ্ছেদকৃত অঙ্গ এই জনপদের ৫১ জায়গায় পতিত হয়েছে মর্মে যখন মন্দীর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এলাকা দখল কার্যক্রম চলতে দেখা যায়, তখন এই অঞ্চলের মানুষ দুর্গা মন্দীর প্রতিষ্ঠা করে পূঁজা অর্চনা আরম্ভ করে। যারা দুর্গা পূঁজা আরম্ভ করে, তাদের উপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়্গ। এই সময়ে এলাকার দুর্গা পূঁজার পুরোহিতসহ অন্যান্য ব্রাহ্মণ, অব্রাহ্মণ, বৌদ্ধ, খৃস্টান অন্যান্য মানুষের উপর নানান অত্যাচার-নিপীড়ন চলে। ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্যান্য শ্রেণিকে অচ্ছুৎ বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। ব্রাহ্মণকে বাঙালি সম্প্রদায়ের হর্তা-কর্তা হিসেবে নিয়োজিত করে অন্যদেরকে উচ্ছেদ করার দায়িত্ব কর্তৃত্ববাদী ব্রাহ্মণদেরই হাতে অর্পন করা হয়। ব্রাহ্মণদের মধ্যে শিক্ষিত জনবল থাকায় ইতিহাস নিজেদের অনুকূলে রচনা ছাড়াও অন্যান্যরা যে অঞ্চলে বহিরাগত তা চেষ্টায় ব্রতী হন। অত্যাচার নিপীড়নের শিকার হয়ে অন্যান্য ধর্মের লোকেরা এই এলাকা ছেড়ে যারা ভারত বর্ষের অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে তাদের মধ্যে বাংলাদেশে আসা জনগোষ্ঠী মুসলমান, ভারত নেপালে যাওয়া জনগোষ্ঠী দলিতরূপে আজও বিদ্যমান

চর্যাপদ আবিস্কৃত হলে এর পদাবলীতে বাঙ্গালী সম্পর্কে বাংলাদেশী কবি ভুসুকুপা যে ঈঙ্গিত দিয়েছে, তা যেনো প্রতিষ্ঠা না পায় সে জন্যও পরবর্তীতে চলে নানারূপ নেতিবাচক অলোচনা। আলোচনা থেকে বুঝা যায়পরিকল্পিতভাবে একটি বিষয়কে আড়াল করে অন্য আরেকটি বিষয় প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে কারা এসেছিলো বরজায় পদ্মার খালে। দক্ষিণ থেকে ভাগীরথী হয়ে পদ্মায় আসে নিতো ? এই প্রশ্ন যেনো কেউ তুলতে না পারে, জন্যই কি ইতিহাসের ধারা অন্যদিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়েছে ?

বাংলা ভাষার সাহিত্যিকগণের মধ্যে প্রায় সকলেই ছিলেন ব্রাহ্মণ। কারণ অব্রাহ্মণদের শিক্ষাগ্রহণ ছিলো অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। সুতরাং ব্রাহ্মণদের উচ্চ মর্যাদা রক্ষা এবং বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের হর্তা-কর্তার পদ বহাল রাখার জন্য চর্যাপদকে উপলক্ষ করে আরম্ভ হয় আরেক অধ্যায়। চর্যাপদের শ্লোককে নিজেদের পক্ষে কিভাবে ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে চলে গবেষণা। একবার প্রশ্নটি উঠলো না যে, চর্যাপদ নেপালে গেলো কিভাবে? যারা নেপালে চর্যাপদ নিয়ে গেলো তারা কারা। চর্যাপদ রচনাকারীগণ ছিলেন রাজা-জমিদার, ব্রাহ্মণ এবং অতি পিছিয়ে পরা মানুষ। কিন্তু কৌশলে ব্রাহ্মণ (কর্তৃত্ববাদী) নিজেদেরকে আলাদা করে ফেললেন এই বলে যে, চর্যাপদ রচয়িতা ব্রাহ্মণগণ বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছে। বাঁকিদের বলা হলো নাস্তিক। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বখতিয়ার খলজি যদি বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস করে তাহলেতো বৈদিক মতের মানুষদের উপকার করেছে। তাকেতো বরং পুরস্কৃত করার প্রয়োজন ছিলো। কেন কথাটি এভাবে আসছে না ইতিহাসে? সে বাংলা বিজয় করে ১২০৬ সালে। কিন্তু ভুসুকুপার বঙ্গালী সৃষ্টি হয়েছে ৭৭০ থেকে ৮১০ খৃস্টাব্দের মধ্যে। ইতিহাসের ধারাকে অন্য ধারায় প্রবাহিত করার লক্ষে পুরো ঘটনা- টেনে আনা হয়েছে ২০০ বছর পরে। ১২০০ খৃস্টাব্দে ঢাকেশ্বরী মন্দীরে দুর্গাপূজায় কোনো জটিলতা ছিলো না। শুধুমাত্র পশ্চিম বাংলার বাসিন্দাদেরকে বাঙালি বলা হয়ে থাকে কথা প্রমাণের চেষ্টায় বাংলা অভিধানে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষকে অবাঙালি বলে উল্লেখ করা হয়েছে? কাক কাকের মাংস খায় না, ফর্মুলাটি কি এখানে যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় নি? সর্বত্র ব্রাহ্মণরাজ কায়েম ছাড়া এটাকে আর কী বলা যেতে পারে। আজকের ভারতেও চলছে সেই পুরনো খেলা। আরএসএস-বিজেপি নামে সেই পুরনো শক্তি মুসলিম, খৃস্টান, বৌদ্ধ নিধনে মাঠে নেমেছে।

শেষ কথাঃ

২০১৪ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে বাঙ্গালী শব্দের অর্থ সংশোধন করা হয়েছে। লেখা হয়েছে বাংলা ভাষায় যারা কথা বলে তারা বাঙ্গালী। ২০১৪ সালের আগে যারা যারা মৃত্যুবরণ করেছে, বাংলা ভাষায় কথা বলেও তারা জেনে গেছে তারা অবাঙ্গালী। এই সংশোধন বাংলা ভাষাভাষী মানুষ হিসেবে সত্যিই আমরা গর্ববোধ করতে পারি। কিন্তু আগামী দিনে বাঙ্গালী শব্দের অর্থ যে আবার পরিবর্তন করা হবে না, তার গ্যারান্টি কে দেবে ? ১৯০৭ সালে চর্যাপদ আবিস্কারের পর থেকেই চলছে এই ভাষার উৎপত্তিস্থল কোথায় তা নিয়ে বিতর্ক। কোথায় গিয়ে ঠেকবে এই বিতর্ক তা- কেউ আমরা বলতে পারি না। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগে, এই বিতর্কের কি কোনোই মিমাংসা নেই। ভাষার জাতি হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে মুখ ফিরিয়ে থাকলে চলবে কি ? আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় কী বলেছেন সেদিকে মন না দিয়ে, চর্যাপদ কি বলেছে নির্মোহ গবেষণার মাধ্যমে তা উদ্ধার করে দেখা দরকার আমাদেরকেই। ভুসুকুপা তার শ্লোকে চণ্ডালে বা বঙ্গালী শব্দ কি অর্থে প্রয়োগ করেছেন, বজ্র তথা বর্জের কী প্রায়োগিক অর্থ হতে পারে? কে গৃহিণীরূপে প্রতিষ্ঠা পেলো, কারা তাকে প্রতিষ্ঠা করলো, কেনো করলো সে বিষয় জানা-বুঝা একান্ত জরুরী। তা না হলে, হয়তো একদিন দেখা যাবে- আমাদেরই চোখের সামনে বাংলাদেশের অভিধান আবারও সংশোধন করা হবে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারবে বাঙ্গালী শব্দের নতুন আরেক অর্থ, আরেক মানে ভিন্ন ব্যাখ্যায়।

সমাপ্ত

=============

সাগর আল হেলাল

নলদহ, পাবনা।

1 comment:

Powered by Blogger.